থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে কতদিন লাগে

Spread the love

থাইল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? আমিও একবার তাই ছিলাম। ব্যাংককের ব্যস্ত রাস্তা, ফি ফি আইল্যান্ডের নীল জল, আর পাত্তায়ার রাতের জীবন সব কিছু মিলিয়ে থাইল্যান্ড এক অসাধারণ গন্তব্য। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা মূল প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খায়: থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে আসলে কতদিন লাগে?

আমি যখন প্রথমবার ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম, তখন আমারও একই প্রশ্ন ছিল। আর আজকে সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি থাইল্যান্ড ভিসার পুরো প্রসেস, টাইমলাইন, খরচ আর টিপস।

থাইল্যান্ড ভিসা পেতে আসলে কতদিন সময় লাগে?

সোজা উত্তর: ১০ কার্যদিবস বা প্রায় দুই সপ্তাহ। থাইল্যান্ড এখন ই-ভিসা সিস্টেম চালু করেছে (২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি থেকে), যেটা পুরো প্রসেসটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আপনি অনলাইনে আবেদন করবেন, আর ইমেইলেই ভিসা কনফার্মেশন পেয়ে যাবেন।

তবে বাস্তবতা হলো, কিছু ক্ষেত্রে ৩ থেকে ১০ দিনের মধ্যেও ভিসা মিলতে পারে। এটা নির্ভর করে আপনার ডকুমেন্ট কতটা ঠিকঠাক আছে, পিক সিজন কিনা, আর এম্বেসির ওয়ার্কলোডের ওপর।

আমার পরামর্শ: ট্রাভেল ডেট থেকে অন্তত ৩-৪ সপ্তাহ আগেই আবেদন করুন। শেষ মুহূর্তে ঝামেলায় পড়তে চান না তো!

থাইল্যান্ড ভিসার ধরন

থাইল্যান্ড ভিসা মানেই কিন্তু এক ধরনের না। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য অনুযায়ী বেছে নিতে হবে:

১. সিঙ্গেল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা

এটা সবচেয়ে কমন। আপনি একবার থাইল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন, থাকতে পারবেন ৬০ দিন, আর ভিসাটা বৈধ থাকবে ৩ মাস। খরচ? ৪,৫০০ টাকা (২০২৫ সালের আপডেট অনুযায়ী)।

২. মাল্টিপল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা (METV)

ঘন ঘন যাতায়াত করতে চান? এই ভিসা ৬ মাস বৈধ থাকে, আর প্রতিবার ঢোকার সময় ৬০ দিন করে থাকতে পারবেন। অবশ্যই, খরচটাও একটু বেশি—২২,৫০০ টাকা

৩. নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা

বিজনেস, স্টাডি বা অন্য কাজে যাচ্ছেন? এক বছরের এই ভিসার খরচও ২২,৫০০ টাকা

মনে রাখবেন: সব ভিসায় প্রসেসিং চার্জ হিসেবে আরও ১,৭০০ টাকা লাগবে।

থাইল্যান্ড ভিসার জন্য কী কী লাগবে

ভিসা রিজেক্ট হওয়ার প্রধান কারণ হলো ডকুমেন্ট ভুল বা অসম্পূর্ণ থাকা। তাই প্রথমেই আপনার চেকলিস্ট রেডি করে নিন:

মূল ডকুমেন্ট:

  • পাসপোর্ট (মেয়াদ কমপক্ষে ৬ মাস থাকতে হবে—এটা খুবই জরুরি!)
  • পাসপোর্ট সাইজ ছবি (২ কপি, সাইজ ৩.৫×৪.৫ সেমি, সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড)
  • ব্যাংক স্টেটমেন্ট (গত ৬ মাসের, ব্যালেন্স দেখাতে হবে)
  • ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট
  • এয়ার টিকেট বুকিং (রিটার্ন টিকেট অবশ্যই)
  • হোটেল বুকিং কনফার্মেশন
  • পেশার প্রমাণপত্র (ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স, চাকরিজীবীদের NOC, ছাত্রদের স্টুডেন্ট আইডি)
  • ভিসা আবেদন ফরম (অনলাইনে পূরণ করতে হবে)

অনলাইনে থাইল্যান্ড ভিসা আবেদন

২০২৫ সাল থেকে থাইল্যান্ড ই-ভিসা সিস্টেম চালু হয়েছে। আর এটা সত্যিই গেম চেঞ্জার! আগে যেখানে এম্বেসিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হতো, এখন ঘরে বসেই সব করতে পারবেন।

ধাপ ১: অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন

www.thaievisa.go.th ওয়েবসাইটে যান। আপনার ইমেইল আর প্যাসওয়ার্ড দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খুলুন।

ধাপ ২: আবেদন ফরম পূরণ

সব তথ্য সঠিকভাবে দিন। একটা বানান ভুল বা ভুল তারিখও ভিসা রিজেক্টের কারণ হতে পারে। আমি নিজে একবার পাসপোর্ট নম্বরে একটা সংখ্যা ভুল টাইপ করে ফেলেছিলাম—ভাগ্যিস জমা দেওয়ার আগে ক্যাচ করতে পেরেছিলাম!

ধাপ ৩: ডকুমেন্ট আপলোড

সব কাগজপত্র স্কান করে আপলোড করুন। ফাইল সাইজ আর ফরম্যাট ঠিক আছে কিনা চেক করে নিন।

ধাপ ৪: পেমেন্ট করুন

Commercial Bank of Ceylon বা Eastern Bank Limited-এর মাধ্যমে অনলাইনে পেমেন্ট করতে পারবেন। আপনার কার্ড আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য চালু আছে তো?

ধাপ ৫: ইমেইল চেক করুন

১০ কার্যদিবসের মধ্যে ইমেইলে ভিসা কনফার্মেশন আসবে। স্প্যাম ফোল্ডারও একবার দেখে নিন!

থাইল্যান্ড ভিসা খরচ ২০২৫

চলুন একটা টেবিলে পুরো খরচটা দেখে নিই:

ভিসার ধরন ভিসা ফি প্রসেসিং চার্জ মোট খরচ
সিঙ্গেল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা ৪,৫০০ টাকা ১,৭০০ টাকা ৬,২০০ টাকা
মাল্টিপল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা ২২,৫০০ টাকা ১,৭০০ টাকা ২৪,২০০ টাকা
নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা (১ বছর) ২২,৫০০ টাকা ১,৭০০ টাকা ২৪,২০০ টাকা

টোটাল ট্রাভেল কস্ট: ভিসা, এয়ার টিকেট, হোটেল বুকিং—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ড যেতে ১ লক্ষ থেকে ১.৫ লক্ষ টাকা বাজেট রাখুন। এয়ার টিকেট মৌসুমভেদে ১৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

ভিসা রিজেক্ট হওয়ার কারণ

থাইল্যান্ড ভিসা রিজেক্ট হওয়া মানে শুধু টাকার লস না, আপনার পুরো ট্রাভেল প্ল্যানটাই মাটি হয়ে যায়। তাই এই কমন ভুলগুলো এড়িয়ে চলুন:

১. পাসপোর্টের মেয়াদ কম আপনার পাসপোর্টে অন্তত ৬ মাস মেয়াদ থাকতেই হবে। ৫ মাস ২৯ দিন থাকলেও চলবে না!

২. ব্যাংক ব্যালেন্স কম পর্যাপ্ত ব্যাংক ব্যালেন্স না থাকলে এম্বেসি মনে করবে আপনি থাইল্যান্ডে গিয়ে টাকার সমস্যায় পড়বেন। সিঙ্গেল এন্ট্রির জন্য অন্তত ২-৩ লক্ষ টাকা ব্যালেন্স দেখান।

৩. জাল বা ভুল ডকুমেন্ট এটা করবেন না, প্লিজ। একবার ধরা পড়লে ভবিষ্যতে আর কোনো ভিসা পাবেন না।

৪. অসম্পূর্ণ আবেদন ফরমের একটা ঘরও খালি রাখবেন না। সবকিছু সঠিক আর পরিষ্কারভাবে পূরণ করুন।

৫. সন্দেহজনক ট্রাভেল হিস্ট্রি আপনার পাসপোর্টে যদি আগে ভিসা ভায়োলেশনের রেকর্ড থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে।

থাইল্যান্ডে গিয়ে ভিসা এক্সটেন্ড করা যায়?

হ্যাঁ, যায়! আপনি যদি থাইল্যান্ডে থেকেই আরও কিছুদিন থাকতে চান, তাহলে লোকাল ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে অতিরিক্ত ৩০ দিনের এক্সটেনশন নিতে পারবেন।

এক্সটেনশন ফি: ১,৯০০ থাই বাত বা প্রায় ৬০ ডলার

তবে মনে রাখবেন, এক্সটেনশন শুধু একবারই পাওয়া যায়। তাই ৬০+৩০=৯০ দিন থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ।

মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার সুবিধা

আপনি যদি বিজনেস বা ঘন ঘন ভ্রমণের কারণে থাইল্যান্ডে যেতে চান, তাহলে মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা নিন। এর সুবিধা:

  • ৬ মাস বৈধতা
  • যতবার ইচ্ছা ঢুকতে পারবেন
  • প্রতিবার ৬০ দিন করে থাকতে পারবেন
  • প্রতিবার ৩০ দিনের এক্সটেনশন পাওয়া যায়

খরচ বেশি হলেও, বারবার ভিসা অ্যাপ্লাই করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন।

থাইল্যান্ড ভিসা ছাড়া যাওয়া যায়?

দুঃখজনক উত্তর: না। বাংলাদেশি সাধারণ পাসপোর্টধারীদের অবশ্যই ভিসা লাগবে। তবে সরকারি পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন।

কিছু দেশের নাগরিকদের (যেমন আমেরিকা, ইউরোপ) ভিসা এক্সেম্পশনের সুবিধা আছে, তারা ৬০ দিন পর্যন্ত ভিসা ছাড়াই থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা বাংলাদেশিদের জন্য এই সুবিধা নেই।

থাইল্যান্ড ভিসা

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু টিপস শেয়ার করছি:

১. আর্লি বার্ড ক্যাচ করে! ট্রাভেল ডেটের ৩-৪ সপ্তাহ আগেই আবেদন করুন। পিক সিজনে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) আরও আগে করুন।

২. ডকুমেন্ট রিডাবিলিটি চেক করুন স্কান কপি পরিষ্কার আছে তো? ঝাপসা ছবি বা পড়তে না পারা ডকুমেন্ট রিজেক্টের কারণ হতে পারে।

৩. ব্যাংক স্টেটমেন্টে রেগুলার ট্রানজেকশন দেখান হঠাৎ করে বড় অ্যামাউন্ট ডিপোজিট করবেন না। এটা সন্দেহজনক মনে হতে পারে।

৪. হোটেল বুকিং ফ্লেক্সিবল রাখুন রিফান্ডেবল বুকিং করুন, যাতে ভিসা না পেলে ক্যানসেল করতে পারেন।

৫. ইমেইল চেক করতে থাকুন ভিসা কনফার্মেশন ইমেইলে আসবে। নিয়মিত ইনবক্স আর স্প্যাম ফোল্ডার চেক করুন।

থাইল্যান্ড ভিসা প্রসেসিং টাইমলাইন

পদক্ষেপ সময়
অনলাইন আবেদন জমা ১-২ ঘন্টা
ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন ৩-৫ দিন
ভিসা প্রসেসিং ৫-৭ দিন
ইমেইলে কনফার্মেশন ১ দিন
মোট সময় ১০-১৫ দিন

শেষ কথা

থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে কতদিন লাগে? এখন আপনি জানেন ১০ কার্যদিবস বা দুই সপ্তাহ। কিন্তু শুধু টাইম জানলেই হবে না, সঠিক প্রসেস ফলো করতে হবে।

মনে রাখবেন:

✅ প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট রেডি রাখুন

✅ সময় নিয়ে আবেদন করুন

✅ অনলাইন ই-ভিসা সিস্টেম ব্যবহার করুন

✅ পাসপোর্টের মেয়াদ চেক করুন

✅ পর্যাপ্ত ব্যাংক ব্যালেন্স দেখান

থাইল্যান্ড এক অসাধারণ দেশ। ব্যাংককের মন্দির, পাত্তায়ার সমুদ্র সৈকত, চিয়াং মাইয়ের পাহাড় সব মিলিয়ে একটা মেমোরেবল ট্রিপ হতে চলেছে। আর ভিসার ঝামেলা যদি এড়াতে পারেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!

আপনার থাইল্যান্ড ভিসা আবেদন শুরু করুন আজই: www.thaievisa.go.th

আর হ্যাঁ, আপনি যখন ব্যাংককের ওয়াট আরুনে সূর্যাস্ত দেখবেন, আমার কথাটা মনে পড়বে “জার্নি শুরু হয় প্রথম পদক্ষেপ থেকে, আর থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে সেটা হলো ভিসা!”

Leave a Comment

Scroll to Top