ভাবুন তো একবার, কুয়ালালামপুরের জমজমাট রাস্তা আর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের ঝলমলে আলো ছেড়ে আপনি পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের বুকে ঐতিহাসিক রোমানিয়ায়। যেখানে ড্রাকুলার ক্যাসেলের গল্প আর কার্পেথিয়ান পর্বতমালার অসাধারণ সৌন্দর্য আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। অনেকের কাছেই এই স্বপ্নটা অধরা মনে হতে পারে, কিন্তু সঠিক তথ্য আর পরিকল্পনা থাকলে মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।
আপনি যদি মালয়েশিয়ায় কর্মরত একজন বাংলাদেশী হন এবং ইউরোপে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তাহলে এই ব্লগ পোস্টটি আপনার জন্যই। আমি আপনাকে ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি এমনভাবে বুঝিয়ে বলব, যেন মনে হবে আমি আপনার পাশেই বসে আছি। চলুন, শুরু করা যাক!
কেন মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যাবেন?
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় রোমানিয়াতে কাজের সুযোগ এবং জীবনযাত্রার খরচ দুটোই বেশ সহনীয়। বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন, প্রোডাকশন, এবং হসপিটালিটি সেক্টরে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। আর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ? রোমানিয়া খুব শীঘ্রই সেনজেনভুক্ত (Schengen Area) দেশের তালিকায় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে, যা আপনার জন্য পুরো ইউরোপে ভ্রমণের দরজা খুলে দেবে। ব্যাপারটা দারুণ না?
মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যাওয়ার পথ
পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি জার্নির মতো করে ভাবুন। প্রতিটি স্টেশনে আপনাকে কিছু কাজ শেষ করতে হবে। চলুন দেখে নেই সেই স্টেশনগুলো কী কী।
চাকরির অফার লেটার বা ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করা
মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম ধাপ হলো একটি বৈধ চাকরির ব্যবস্থা করা। এটা ছাড়া আপনি এক পা-ও এগোতে পারবেন না।
- কীভাবে জব খুঁজবেন?
- অনলাইন জব পোর্টাল: LinkedIn, Ejobs.ro, Bestjobs.ro-এর মতো পোর্টালে আপনার সিভি আপলোড করুন।
- এজেন্সির সাহায্য: মালয়েশিয়া বা বাংলাদেশে অনেক নির্ভরযোগ্য এজেন্সি রয়েছে যারা রোমানিয়ার জন্য কর্মী নিয়োগ করে। তবে সাবধান! এজেন্সির বৈধতা অবশ্যই যাচাই করে নেবেন। কারও মিষ্টি কথায় ভুলে ফাঁদে পা দেবেন না।
- সরাসরি কোম্পানিতে আবেদন: আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী রোমানিয়ান কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটে সরাসরি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন।
আপনার সিভি বা বায়োডাটাটি Europass ফরম্যাটে তৈরি করলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। একবার কোনো কোম্পানি আপনাকে নির্বাচন করলে, তারাই আপনার জন্য রোমানিয়ার General Inspectorate for Immigration (IGI) থেকে ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করবে।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া
ওয়ার্ক পারমিট হাতে পাওয়ার পর শুরু হবে আসল খেলা—ভিসা আবেদন। কুয়ালালামপুরে অবস্থিত রোমানিয়ান দূতাবাস থেকেই আপনাকে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
কী কী ডকুমেন্ট লাগবে?
ভিসা আবেদনের জন্য আপনার একটি ফাইল তৈরি করতে হবে, যেখানে নিচের কাগজপত্রগুলো সুন্দর করে সাজানো থাকবে:
- পাসপোর্ট: কমপক্ষে ৬ মাস মেয়াদসহ আসল পাসপোর্ট এবং এর ফটোকপি।
- ভিসা আবেদন ফর্ম: দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে।
- ছবি: সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে তোলা দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- ওয়ার্ক পারমিট: রোমানিয়া থেকে পাওয়া আসল ওয়ার্ক পারমিট।
- ফ্লাইট রিজার্ভেশন: রাউন্ড ট্রিপ বা ওয়ান ওয়ে ফ্লাইট রিজার্ভেশনের কপি।
- বাসস্থানের প্রমাণ: রোমানিয়াতে আপনি কোথায় থাকবেন, তার প্রমাণপত্র (যেমন: ভাড়ার চুক্তি)।
- মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স: কমপক্ষে ৩০,০০০ ইউরো কভারেজসহ ট্র্যাভেল মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স।
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট: মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে।
- শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ: আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সার্টিফিকেট (প্রয়োজনে অ্যাটাস্টেড)।
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট: যদিও এটি সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়, তবে অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা দেখানো ভালো।
কোথায় আবেদন করবেন?
আপনাকে কুয়ালালামপুরে অবস্থিত রোমানিয়ান দূতাবাসে (Embassy of Romania in Kuala Lumpur) যোগাযোগ করতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য তাদের ওয়েবসাইটে নজর রাখুন।
ফ্লাইট বুকিং এবং চূড়ান্ত প্রস্তুতি
ভিসা হাতে পাওয়ার পর আপনার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে আর কোনো বাধা নেই! এখন সময় ফ্লাইট বুক করার।
মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া এয়ার টিকেট প্রাইস কেমন?
সাধারণত, কুয়ালালামপুর থেকে বুখারেস্ট (রোমানিয়ার রাজধানী) যাওয়ার ফ্লাইট ভাড়া নির্ভর করে এয়ারলাইন, সময় এবং আপনি কতদিন আগে টিকেট কাটছেন তার উপর।
- ওয়ান-ওয়ে টিকেট: সাধারণত ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ মালয়েশিয়ান রিংগিত (MYR) বা প্রায় ৩৫,০০০ থেকে ৬০,০০০ বাংলাদেশী টাকা (BDT) থেকে শুরু হয়।
- এয়ারলাইনস: Turkish Airlines, Qatar Airways, Emirates সাধারণত এক বা দুই স্টপসহ ফ্লাইট পরিচালনা করে।
FAQs
চলুন, কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া যাক যা আপনার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
১. মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যেতে মোট কত টাকা লাগে?
এটা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। তবে একটি আনুমানিক ধারণা নিচে টেবিলে দেওয়া হলো:
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই খরচ সম্পূর্ণ আনুমানিক। এজেন্সি এবং পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এটি পরিবর্তিত হতে পারে। যেকোনো এজেন্সির সাথে লেনদেনের আগে ভালোভাবে যাচাই করে নিন।
২. রোমানিয়া ভিসা প্রসেসিং হতে মালয়েশিয়াতে কত সময় লাগে?
সাধারণত, ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদন হতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগে। এরপর দূতাবাসে ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার পর ১৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তাই পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় হাতে রাখা ভালো।
৩. রোমানিয়াতে সর্বনিম্ন বেতন কত?
২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, রোমানিয়াতে সর্বনিম্ন বেতন (Minimum Gross Salary) প্রায় ৩,৩০০ RON (রোমানিয়ান লিউ), যা ট্যাক্স বাদে হাতে প্রায় ২,০০০ RON আসে। এটি প্রায় ৪১০ ইউরো বা ৫০,০০০ বাংলাদেশী টাকার সমান। তবে আপনার অভিজ্ঞতা এবং কাজের ধরনের উপর বেতন আরও বেশি হতে পারে।
৪. আমি কি সরাসরি বাংলাদেশ থেকে না গিয়ে মালয়েশিয়া থেকে আবেদন করতে পারি?
হ্যাঁ, আপনি যদি মালয়েশিয়াতে বৈধভাবে বসবাস এবং কাজ করেন, তাহলে কুয়ালালামপুরে অবস্থিত রোমানিয়ান দূতাবাস থেকেই ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
শেষ কথা
মালয়েশিয়া থেকে রোমানিয়া যাওয়ার পথটি হয়তো একটু দীর্ঘ, কিন্তু অসম্ভব নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধৈর্য ধরা এবং সঠিক ও বৈধ পথে এগিয়ে যাওয়া। কোনো দালালের খপ্পরে পড়ে আপনার স্বপ্নের পাশাপাশি জমানো টাকাও নষ্ট করবেন না। সবসময় অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রের উপর বিশ্বাস রাখুন।
আপনার ইউরোপ যাত্রার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা। কে জানে, হয়তো একদিন বুখারেস্টের কোনো ক্যাফেতে বসেই আপনি এই লেখাটি পড়বেন আর হাসবেন!
আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। আপনার ইউরোপ যাত্রার গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম!
আমি একটি প্রাইভেট ভিসা প্রসেসিং কোম্পানিতে জব করি। পাশাপাশি এই ব্লগটিতে লেখালেখি করি। আমি ব্রাক ইউনিভার্সিটে থেকে এমবিএ করেছি।